স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। এরপর সারা দেশে সব পুলিশ লাইনসেও একযোগে হামলা চালানো হয়। প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধও রাজারবাগ থেকেই শুরু হয়। আর তাই তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল প্রকৃত ইতিহাস জানাতে এবং বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্ব, সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমা ধরে রাখতে গড়ে তোলা হয়েছে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’।
২০০৯ সালে তৎকালীন আইজি নূর মোহাম্মদ (বর্তমান এমপি) ও ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার এ কে এম শহীদুল হকের (সাবেক আইজিপি) সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশের তৎকালীন ডিসি মো. হাবিবুর রহমান (বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি) জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। মিলিটারি একাডেমি পরিদর্শন করে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নেন মো. হাবিবুর রহমান। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের টেলিকম ভবনে দুটি রুম নিয়ে প্রথম পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। আর এখনকার চার তলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই। জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ ও ইউনিফরম রাখা হয়েছে।
মো. হাবিবুর রহমান ও তৎকালীন এসি আবিদা সুলতানা (বর্তমানে লালমনিরহাটের এসপি) এই দুই জন মিলে প্রথমে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, বন্দুকসহ নানা দুষ্প্রাপ্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে সেখানে রাখা হয়েছে। দেয়াল জুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। এছাড়া মোঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে ব্যবহৃত পুলিশের বিভিন্ন অস্ত্র, সরঞ্জাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশের বীরত্বগাঁথা স্থান পেয়েছে এখানে।
১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের আত্মত্যাগের ইতিহাস রক্ষিত আছে এই পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ৭১’এর ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনাবাহিনী একযোগে আক্রমণ করেছিল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে রাজারবাগেই বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পুলিশের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে প্রাণ হারান শতাধিক পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা। রাতেই পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করেছিলেন কনস্টেবল আবদুল আলি। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল তৎকালীন আইজিপি (প্রয়াত) তসলিম উদ্দিন আহাম্মদসহ ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন।
সেই সময়ে সরকারের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার বাঙালি সদস্য পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করেন এবং কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের একজন ডিআইজি, চার জন পুলিশ সুপার, এক জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এক জন ডিএসপি, এক জন এসডিপিও, ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শকসহ ৭৫১ জন পুলিশ শহিদ হন। এদের মধ্যে রয়েছেন—তৎকালীন রাজশাহীর ডিআইজি শহিদ মামুন মাহমুদ, রাজশাহীর পুলিশ সুপার শহিদ শাহ আবদুল মজিদ, কুমিল্লার পুলিশ সুপার শহিদ কবির উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার শহিদ এম শামসুল হক, পিরোজপুর মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (এসডিপিও) এবং কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও ডক্টর জাফর ইকবালের বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদসহ অনেকে। উল্লেখ্য, পুলিশে পাঁচ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। এরমধ্যে তিন জন বীরবিক্রম ও দুই জন বীর প্রতীক।
২০১৫ সালের ১০ মার্চ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থায়ী ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ‘জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ ২০১৭’র উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নব-নির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন। ভবনটি অত্যাধুনিক, সুদৃশ্য ও নান্দনিক অবয়বে নির্মিত হয়েছে। দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত ভবনটির ডিজাইন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত স্থপতি মীর আল-আমিন। ইন্টিরিয়রে ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন রশিদ বনি।
সেই রক্তাক্ত ভূমিতেই জাদুঘর : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে পুলিশের অকুতোভয় সদস্যরা যে স্থান থেকে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন, সেই রক্তাক্ত ভূমিতেই জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুর্লভ আলোকচিত্রসহ তার শৈশব ও রাজনৈতিক অসাধারণ মুহূর্তগুলো তুলে ধরা হয়েছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে বঙ্গবন্ধু গ্যালারিতে বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ১৫টি ছবি রয়েছে। আরো আছে ভার্চুয়াল লাইব্রেরি ও স্যুভেনিয়র। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকাশনা, কার্যক্রমসহ পুলিশের আত্মত্যাগের স্মৃতি এই জাদুঘরে আছে। সারদা পুলিশ একাডেমির তৎকালীন প্রিন্সিপাল আব্দুল খালেকের হাতের লেখা চিঠিও রক্ষিত আছে এই জাদুঘরে।
ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি বৃহস্পতিবার পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় সেখানে ডিআইজি হাবিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক এআইজি তালেবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর ২০০০ সালে তখন রাজারবাগে ডিউটি করতেন এসি হাবিবুর রহমান। ২০০১ সালে বিএনপির ক্ষমতায় আসার পর তার চাকরি চলে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি আবার চাকরি ফিরে পান। তখন তিনি ছিলেন ডিসি (হেডকোয়ার্টার্স)। তখন থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার পরিকল্পনা করেন হাবিবুর রহমান। প্রথমে এর জনবল ছিল ১৮ জন। ১৮৫৭ সালে পুলিশ কীভাবে গঠন করা হলো, সেই সময়ের আইন-কানুনসহ পুলিশের ভূমিকার সব কিছু এই জাদুঘরে আছে। জাদুঘরে পুলিশের বিবর্তনের ইতিহাসের ছবি ও লেখা তুলে ধরা হয়েছে। মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলের পুলিশ বাংলাদেশ আমলে এসে আধুনিক পুলিশে রূপান্তরিত হয়।